রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী

 


বিশেষ প্রতিবেদন : বিশ্বমাতা এ পৃথিবীর বুকে যে সকল মহান ব্যক্তিদের জন্ম দিয়েছেন তাদের মধ্যে অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে মানুষ টি জড়িয়ে আছেন তার নামই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি , বিশ্ব কবি রূপে বিরাজ করে আসছেন তিনি বহু শতক ধরে ।  যার কাব্যের মাধুর্যের জেরে বাংলা ভাষা আজ পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্ট ভাষা নামে খ্যাত লাভ করেছে । 


শিক্ষাজীবন

       সেই সময় বাংলার সবচেয়ে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমী এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করলেও স্কুল শিক্ষার প্রতি তার বিন্দু মাত্র আগ্রহ ছিল না । কারণ সে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়াশুনা করা পছন্দ করতেন না । ফলে বাড়িতে গৃহশিক্ষকের দ্বারাই তার প্রারম্ভিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। এরপর ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যান এবং সেখানেই প্রথম ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। তারপর ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইন বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। বলাবাহুল্য এখানে থাকাকালীন বিখ্যাত ইংরেজি সাহিত্যিক শেক্সপিয়ার সহ নানা গুণী মানুষ ও সাহিত্যিক দের শরণাপন্ন হন। দীর্ঘ দেড় বছর সেখানে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি না নিয়েই, ব্যারিস্টারি পড়া শেষ না করেই ১৮৮০ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। 



কর্মজীবন

           

     শৈশব জীবন তার থেকেই সাহিত্যচর্চার প্রতি এক অসীম ভালোবাসা ছিল। মাত্র আট বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুর করেন । এরপর তিনি ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্য সংকলন, সর্বমোট ৯৫টি ছোট গল্প ও ১৯১৫ খানি গান রচনা করে গেছেন। 

    

      ভারতী পত্রিকায় ১৮৭৭ সালে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশ করেন। সেগুলো ছিলো ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা আর ভিখারিণী ও করুণা নামে দুটো সুন্দর ছোটগল্প। এগুলোর মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পায়।


এরপর ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “কবিকাহিনী”। এছাড়াও পরে তিনি রচনা করেছিলেন “সন্ধ্যাসংগীত” নামক আরেকটি কাব্যগ্রন্থ। “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” নামে লেখা তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা এই কাব্যগ্রন্থেরই অন্তর্গত ছিলো।


 তবে ১৮৯১ সালে পিতার আদেশে নদীয়া, পাবনা, রাজশাহী জেলা এবং উড়িষ্যার জমিদারগুলির তদারকির কাজও করেন।


 সাহিত্যচর্চা


১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে তার প্রথম বই ‘ কবিকাহিনী ’ প্রকাশিত হয় । তারপর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে সন্ধ্যাসঙ্গীত , প্রভাত সঙ্গীত , ছবি ও গান , কড়ি ও কোমল , মানসী , সােনার তরী কাব্যসমূহ । তারপর বের হলাে চিত্রা , চৈতালী , কণিকা , কল্পনা , কথা ও কাহিনী , নৈবেদ্য , খেয়া , গীতাঞ্জলি , গীতালি ইত্যাদি । 


শুধু কাব্যই নয় , নাটক , প্রবন্ধ , গল্প , উপন্যাস , রসরচনা , সমালােচনা , রূপক নাটক , শিশুসাহিত্য , বিজ্ঞান , সমাজতত্ব , শিক্ষাতত্ব , সঙ্গীত , স্কুলপাঠ্য , ভ্রমণকাহিনী , সাহিত্য ও শিল্পের প্রায় সব ক্ষেতেই তার স্বচ্ছন্দ বিচরনের ফলে যােগফল হলাে বাংলা সাহিত্যের বর্তমান চরম উৎকর্ষ সাধন ও উন্নতি । তিনি প্রায় দু’হাজারের মতাে ছবিও এঁকেছেন ।


১৯১২ সালে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় লন্ডনের ইন্ডিয়া সােসাইটি থেকে । সঙ্গে সঙ্গে প্রতীচ্যের বিদগ্ধ সমাজে সাড়া পড়ে যায় । আইরিশ কবি ডব্লিউ . বি . ইয়েস ইংরেজি গীতাঞ্জলির ভূমিকা লেখেন ।


 ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশরাজ কবিগুরুকে ‘ নাইট ’ উপাধিতে ভূষিত করেন । ১৯১৯ খ্রীঃ জালিওয়ালাবাগে নিরস্ত্র ভারতীয়দের ব্রিটিশ সৈন্যরা নির্মমভাবে হত্যা করলে তার প্রতিবাদে তিনি ঐ উপাধি । পরিত্যাগ করেন ।



 রবীন্দ্রনাথ ইউরােপ , আমেরিকা , চীন , জাপান , রাশিয়া , মালয় , পারস্য প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন এবং এইসব দেশে বহু বক্তৃতা ও রচনা পাঠ করেন । পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষাতেই তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়েছে । বিশ্বের সকল দেশের বিদগ্ধ মানুষ , কবি , লেখক , বুদ্ধিজীবীরা তাকে মনীষী হিসাবে শ্রদ্ধা করেন ।



বিবাহিত জীবন :


    ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে আশার পর, ১৮৮৩ সালে ৯ই ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয় বেণীমাধব রায়চৌধুরী নামে ঠাকুরবাড়ির এক  কর্মচারীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে । বিয়ের সময় ভবতারিণীর আবার নতুন করে নামকরণ করা হয় এবং তাঁর নাম পাল্টে রাখা হয় মৃণালিনী দেবী ।


পরবর্তীকালে, মৃণালিনী দেবী ও রবীন্দ্রনাথের মোট পাঁচ সন্তান হয় । তাঁদের নাম যথাক্রমে ছিলো- মাধুরীলতা , রথীন্দ্রনাথ,  রেণুকা,  মীরা এবং শমীন্দ্রনাথ।

    

   কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এঁদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথ মারা যায় ।      


শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা :


 ভারতীয় শিক্ষা ব্যাবস্থার প্রতি তার বরাবর ক্ষোভ ছিল । তিনি বন্ধ ঘরে চার দেওয়ালের মধ্যে যান্ত্রিক শিক্ষা কে বিশ্বাস করতেন না । তার মনে প্রকৃতি মায়ের কোলই হলো বিদ্যার্জনের সব চেয়ে ভালো স্থান ।   আর এই উদ্দেশ্যেই তিনি খোলা আকাশের নিচে শিশুদের বিদ্যালাভের ব্যাবস্থা করার জন্য শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন ।


    মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক বছর আগে বোলপুরের একটি গ্রামে , এক বিশাল জমি কেনেন । সেখানে তিনি ১৮৮৮ সালে একটা আশ্রম ও ১৮৯১ সালে একটা ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ।


বাবার সেই কেনা জমিতে রবীন্দ্রনাথ একটা শিক্ষাকেন্দ্র তৈরী করতে চেয়েছিলেন , আর এখন থেকেই শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর যাত্রা শুরু হয় । প্রথমে তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন “পাঠ্য ভবন” নামে একটা স্কুল, যেটা বাকি সব স্কুলের থেকে বেশ আলাদা ছিলো । কারণ সেই স্কুল ছিলো সম্পূর্ণ খোলা আকাশের নীচে একটা গাছের তলায়। 

         পরে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি সেই স্কুলকে আরো বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে সেটাকে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেন । যেটার পরবর্তীকালে নাম রাখেন তিনি “বিশ্বভারতী” যা ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ।


সমাজের পিছিয়ে পরা মানুষদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তিনি আবার ১৯২৪ সালে আরেকটি শিক্ষাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করেন যেটা ছিলো “শিক্ষা সত্র” । তিনি এই প্রতিষ্ঠান মাত্র ৭ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে শুরু করেছিলেন। 


       পরবর্তী কালে এই গ্রামেরই তিনি নামকরন করে করেন "শান্তিনিকেতন "। 


শেষ জীবন


জীবনের শেষ কিছু বছর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধারাবাহিক ভাবে শারীরিক অসুস্থতার শিকার হন । রোগ যেন কিছুতেই তার পিছু  ছাড়তে চাইছিলো না । দুবার তো তিনি এমন অসুস্থ হন, যারজন্য তাঁকে বহুদিন বিছানায় শয্যাশায়ী অবস্থায় পরে থাকতে হয় । 


জানা যায় ১৯৩৭ সালে কবি একবার অচৈতন্য হয়ে যান এবং তার শারীরিক অবস্থা আরোও আশঙ্কাজনক হয়ে যায় । যদিও তিনি সেইসময় সেবার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন ঠিকই কিন্তু ১৯৪০ সালে আবার গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর তিনি আর সেরে উঠতে পারেননি ।


    এবং ১৯৪১ সালে ৭ই আগস্ট দীর্ঘ রোগভোগের পর বার্ধক্য জনিত কারণে পরলোক গমন করেন।

নবীনতর পূর্বতন