বিশেষ প্রতিবেদন : সনাতন ধর্মে যেসমস্ত দেব দেবীর আরাধনা করা হয় তাদের মধ্যে মা কালী অন্যতম । তবে মা কালীর রূপ অন্য দেবীদের থেকে অন্যরকম । তার গাত্র বর্ণ অন্যরকম এবং তার শরীরে কোনো আবরণ থাকে না । এছাড়াও তিনি তার বিশাল বড় জ্বিভ বাইরে বের করে রাখেন । এবং তিনি নরমুন্ড মালা ধারণ করেন । এরকম মানা হয় যে দেবী পার্বতী দুষ্ট দের দমন করার জন্য এই রূপ ধারণ করেন ।
স্কন্দপুরান এবং দুর্গার সপ্ত সতীর কথা অনুসারে শঙ্কুসিরা নামক এক দৈতের পুত্র ছিলেন অস্থিসিরা । যে মানুষের অস্থি মজ্জা চিবিয়ে খেত। সে মানুষের সাথে সাথে দেবতাদের উপরেও অত্যাচার করতো । তার অত্যাচারের মাত্রা এতটাই ছড়িয়ে যায় যে দেবতারা একদিন ক্রোধে তাকে বধ করে বসেন।
ওই সময় রক্তবীজ নামক এক দৈত বসবাস করত। যখন সে অস্থিসিরার মৃত্যুর কথা জানতে পারে তখন সে দেবতাদের পরাজিত করার জন্য ব্রহ্মক্ষেত্রে ব্রহ্মাজী কে সন্তুষ্ট করার উদ্দশ্যে ঘোর তপস্যা করা শুরু করলো।
প্রায় পাঁচ লক্ষ্য বছর পর রক্তবীজের ঘর তপস্যায় ব্রহ্মা দেব সন্তুষ্ট হন । এবং সামনে প্রকট হয়ে রক্তবীজ কে বর চাইতে বলেন ।
ব্রহ্মা কে সামনে দেখে রক্তবীজ তার ধ্যান থেকে উঠে আসেন এবং ব্রহ্মা কে প্রণাম করেন । এবং বললেন " হে পরম পিতা আপনি যদি আমাকে বর দিতেই চান তাহলে আমায় এই দিন যে আমায় যেনো কোনোদিনও কোনো দেবতা , দৈত , গন্ধর্ব , পিশাচ , পশুপাখি , মানুষ প্রমুখ কেউ হত্যা করতে না পারে। এবং আমার শরীর থেকে রক্ত যদি মাটিতে পরে তাহলে সেই রক্ত থেকে যেনো আমার মতই বলশালী আরও একটি রক্তবীজের জন্ম হয় " অর্থাৎ তিনি একদিকে ব্রহ্মার কাছে অমরত্বের বর চেয়ে নেন । এই কথা শুনে ব্রহ্মা বলেন "রক্তবীজ তোমার মৃত্যু কোনো পুরুষের দ্বারা হবে না তবে নারীর দ্বারা হবে ।" এইটুকু বলে ব্রহ্মা দেব অন্তর্ধান হয়ে গেলেন ।
এরপর রক্তবীজ বরদানের অহংকারে মানুষের উপর আরও অত্যাচার করা শুরু করে । তার অহংকার এতটাই বেড়ে যায় যে সে স্বর্গলোকেও আক্রমণ শুরু করে । এবং দেবরাজ ইন্দ্রকে যুদ্ধে হারিয়ে স্বর্গলোকে নিজের আধিপত্য স্থাপন করে ।
এরপর দশহাজার বছর পর্যন্ত দেবতাগণ রক্তবীজের ভয়ে , পৃথিবীতে মানুষের সাথে ছদ্মবেশে বসবাস করতে থাকেন ।
কিছু সময়পর ইন্দ্রদেব সহ অন্যান্য দেবতারা ব্রহ্মাজীর কাছে গেলেন । তারা সবাই তাদের অসুবিধার কথা ব্রহ্মাজীকে বললেন । তিনি তাদের কথা শুনে বলেন " আমি আপনাদের এই সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে পারবো না । এই জন্যে আমাদের সবাইকে বিষ্ণুজীর কাছে যাওয়া উচিত ।"
এরপর ব্রহ্মাজী সহ সমস্ত দেবতাগণ বিষ্ণুজীর কাছে গেলেন । কিন্তু বিষ্ণুজীও বললেন যে রক্তবীজ কে মারার ক্ষমতা তার নেই ।
এরপর দেবতাগণ বৈকুণ্ঠ থেকে কৈলাশে যাবার জন্য রওনা হলেন । কিন্তু কৈলাশে যাবার পর তারা জানতে পারেন যে ভগবান শিব এখন
কৈলাশে নেই । তিনি এখন কেদারনাথ এ সরস্বতী নদীর তীরে ধ্যানে মগ্ন । দেবতারা তখন কেদারনাথ ধামে পৌঁছান । সেখানে গিয়ে তারা ভগবান শিব কে সব কথা বলেন। ব্রহ্মা বলেন " মহাদেব আমার বরদানের কারণেই আজকে এই অবস্থা । তাকে দেবতা ,দৈত ,পিশাচ কেউই বধ করতে পারবে না । তবে
হ্যা রক্তবীজকে কেবল একটি নারী তার বধ করতে পারবে ।" তখন ভগবান শিব দেবতাদের আদ্যাশক্তির আরাধনা করতে বলেন।
এরপর সব দেবতাগণ আদিশক্তির আরাধনা শুরু করেন । কিছু সময় পর মা আদ্যাশক্তি মহামায়া , দেবতা দের আরাধনায় প্রসন্ন হয়ে প্রকট হন । এবং তিনি দেবতাদের বরাভয় প্রদান করেন ।
এরপর একদিন দেবতাগণ নারদ জীকে বললেন যে, সে যেনো রক্তবীজের মনে এমন কিছু ভাবনার সৃষ্টি ঘটায় যাতে করে সে দেবীদের সাথে কোনো অপরাধ করার কথা ভাবে।
এরপর নারদ জী রক্তবীজের কাছে গিয়ে বললেন " রক্তবীজ কৈলাস পর্বতে ভগবান শিব থাকেন । ভগবান শিব ছাড়া বাকি সব দেবতা তোমার আজ্ঞা পালন করেন । তারা তোমায় ভয় । কিন্তু শিব জীর কাছে , দেবাঙ্গী নামে এক অবলা নারী থাকে যাকে কোনো দেবতাই হাসিল করতে পারেনি , যেহেতু তাকে রক্ষা করছে ভগবান শিব ।"
নারদ মুনির কথা শুনে রক্তবীজ শিব জীকে মোহিত করার জন্য , দেবী পার্বতীর রূপ ধারণ করে কৈলাসে যান। রক্তবীজের রূপ ও সৌন্দর্য দেখে একবারতো শিব জীও মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন । কিন্তু ওইসময় পার্বতী ওইখানে এসে পৌঁছান । দুই পার্বতীকে দেখে শিব জী চিন্তায় পরে গেলেন। এরপর শিব জী ধ্যানে বসেন ও ধ্যান চোখে তিনি ছদ্মবেশ রূপি রক্তবীজকে চিনতে পারেন । মহাদেব তখন ক্রোধের বসে তাকে অভিশাপ দিলেন "হে দুষ্ট তুই ছলের সাহায্যে পার্বতী রূপ নিয়ে আমার কাছে এসেছিস । এই জন্যে মহেশ্বরী পার্বতীই তোকে বধ করবে ।"
রক্তবীজ তখনকার মতন কৈলাস থেকে ফিরে আসেন ও তার রাক্ষস মন্ত্রীদের সাথে শিব জীকে পরাজিত করার ছক করতে থাকেন । সে রাক্ষসদের বললো "যদি পার্বতী আমার সাথে প্রেম করে , তবে শিবের ধৈর্য্য নিজেথেকেই নষ্ট হয়ে যাবে , পত্নী বিয়োগে শিব মানসিক ভাবে দুর্বলও হয়ে যাবে । তারপর আমরা খুব সহজেই জয়লাভ করবো"। সে এটিও বলে যে শিব তাকে স্ত্রীয়ের হাতে মৃত্যুর অভিশাপও দিয়েছে । কিন্তু যাকে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র পরাজিত করতে পারেননি তাকে একটি স্ত্রী কিভাবে বধ করবে ?
এরপর সে তার সৈন্যদের আদেশ দেয় দেবী পার্বতীকে তার প্রেম নিবেদন করে , তাকে রক্তবীজের কাছে নিয়ে আসতে । দেবী পার্বতী যদি ভালো কথায় আসেন তো ভালো নাহলে তাকে টানতে টানতে নিয়ে আসতে ।
রক্তবীজের আদেশ মতো দৈত্যরা মাতা পার্বতীকে তার প্রেম নিবেদন করেন এবং তাদের সাথে যেতে বললেন । দৈত্যদের কথা শুনে মাতা পার্বতী ক্রোধিতো হয়ে উঠলেন। তিনি তার হুংকারে দৈত্যদের জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিলেন । কিছু দৈত্য কোনক্রমে তাদের প্রাণ বাঁচিয়ে রক্তবীজের কাছে গেলেন ও দেবী পার্বতীর ভয়ংকর রূপের কথা বললেন । এই শুনে রক্তবীজ রেগে যায় । সে তার বাকি সেনা দের কারাগারে বন্দী করে দেন ।
এরপর রক্তবীজ চন্ড - মুণ্ড প্রমুখ রাক্ষসের সাথে কৈলাসে পৌঁছান। ও দেবী পার্বতীর সাথে যুদ্ধ করতে চায় । এই যুদ্ধে মাতা পার্বতী অন্যান্য দেবতাদের শক্তিকে নিজের মধ্যে সমাহিত করে মাতা কালীর রূপ ধারণ করেন ও রাক্ষসদের সাথে লড়তে থাকেন । তিনি চন্ড মুণ্ড সহ অন্যান্য রাক্ষসদের বধ করতে থাকেন । কিন্তু রক্তবীজকে যতবারই আঘাত করতে থাকেন ততবার তার রক্ত থেকে একটি একটি করে নতুন রক্তবীজের সৃষ্টি হতে থাকে । এরফলে তাকে বধ কর খুব কঠিন হয়ে ওঠে ।
এরপর মা কালী হা করে রক্তবীজের সমস্ত রক্ত খেতে থাকেন । এই প্রকারে তিনি অন্যান্য রাক্ষসদের ও রক্ত খেতে শুরু করেন । এই ভাবে মা কালী সমস্ত রাক্ষসদের রক্ত খেয়ে তাদের হত্যা করতে সক্ষম হন ।