বিশেষ প্রতিবেদন : দশ মহাবিদ্যার প্রথম দেবী হলেন মা কালি । যিনি হলেন আদ্যাশক্তি । তিনি দেবী দুর্গা বা পার্বতীর একটি রূপ। তাকে মৃত্যু, সময় ও পরিবর্তনের কর্তা বলে মনে করা হয়। তন্ত্র অনুসারে কালী দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। কেরালা ব্যতীত সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে কালীকে ভগবান শিবের স্ত্রী পার্বতীর রূপ হিসাবে বিশ্বাস করা হয়। কেরালার লোকবিশ্বাস অনুসারে— ভগবান শিবের তৃতীয় নয়ন থেকে রাক্ষসদের ধ্বংস করার জন্য তিনি আবির্ভূতা হন, তাই কেরালায় তাঁকে ভৈরবোপপত্নী মহাকালী বলা হয়।
আমাদের মহাভারতে যে ভাদ্রকালির উল্লেখ আছে , তা দেবী পার্বতীর একটি রূপ। কালী শব্দটি কাল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ । এই শব্দের অর্থহলো কৃষ্ণ বা গৌরবর্ন অর্থাৎ কালো । মহাভারতে কালরাত্রি বা কালি নামে আরও একটি দেবীর উল্লেখ আছে । যিনি যুদ্ধে নিহত যোদ্ধাদের ও পশুদের আত্মা বহন করেন ।আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালি নামে এক দানবীর উল্লেখ পাওয়া যায় ।
কাল শব্দের দুটি অর্থ আছে । প্রথম হলো নির্ধারিত সময় ও দুই মৃত্যু । কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের অর্থ হলো সময়ের থেকেও উচ্চতর । প্রকৃত অর্থে কালকে নিয়ন্ত্রণ ও রচনা করেন যিনি তিনিই কালি ।
কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালি পূজো বিশেষ জাকজমোক সহকারে পালিত হয় । এছাড়াও মাঘ মাসে চতুর্দশী তিথিতে রটন্তি কালি পূজো ও জৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশীতে ফলাহরিণী কালি পূজো বিশেষ জনপ্রিয় । এছাড়াও ভদ্র ও কালি মাসের অমাবস্যায় কালী পূজা বিশেষ ভাবে জনপ্রিয় ।
কালী পূজো বা দীপাবলি আলোর রোশনাই এর পূজো ।
কবে থেকে শুরু হয়েছিল এই কালী পূজো :
কালী পূজো খুব বেশি প্রাচীন নয় । ১৭৬৮ খ্রি: মতান্তরে ১৭৭৭ খ্রি: কাশিনাথ রায় রচিত শ্যামা বা কালীসপর্যাবিধি গ্রন্থে সর্বপ্রথম এই পূজোর উল্লেখ পাওয়া যায় । কথিত আছে নদীয়ার রাজা কৃষণচন্দ্র রায় অষ্ঠাদশ শতকে তার সকল প্রজাকে শাস্তির ভয় দেখিয়ে কালী পূজো করতে বাধ্য করেন । এবং এর সাথে আরও কথিত আছে যে রাজা কৃষণচন্দ্রের পুত্র ঈশনচন্দ্র বহু অর্থ ব্যয় করে কালি পূজোর আয়োজন করতেন । সেই থেকেই নদীয়ার কালীপুজো বিশেষ ভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে । তবে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালীপুজো প্রচলনের কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে ।
সপ্তদশ শতকের নবদ্বীপের তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ অগমবারিষ কে বাংলায় কালী মূর্তি ও কালী পূজোর প্রবর্তক মনে করা হয় । তবে পূর্বে কালী উপাসকগণ তাম্রটাতে ইস্ঠ দেবীর যন্ত্র এঁকে বা খোদাই করে পূজো করতেন ।
মা কালীর কটি রূপ জেনে নিন :
তন্ত্রপুরান অনুসারে কালীর বিভিন্ন রূপের উল্লেখ পাওয়া যায় । তোরল তন্ত্র অনুসারে কালী নয় প্রকার । যথা দক্ষিণ কালিকা , কৃষ্ণ কালী, সিদ্ধ কালিকা ,বুয্য কালিকা , শ্রী কালিকা , ভদ্র কালী, চামুন্ডা কালিকা , শশান কালিকা ও মহা কালী ।
মহাকাল সনিতার অনুসৃত প্রকরণে নয় প্রকার কালির উল্লেখ পাওয়া যায় । তা হলো দক্ষিণ কালী , ভদ্র কালী , শশান কালী , কালো কালী, বুজ্য কালী , কামকলা কালী , ধণ কালিকা , সিদ্ধি কালী ,চণ্ডী কালিকা ।
অভিনব গুপ্তের তন্ত্রলোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থ দুটিতে কালির ১৩ টি রূপের উল্লেখ আছে । যথা সৃষ্ঠি কালী , স্থিতি কালী , সংহার কালী , রক্ত কালী , যম কালী , মৃত্যু কালী , রুদ্র কালী , পরমআর্ঘো কালী , মার্তন্দ কালী , কলগ্নিরুদ্র কালী , মহা ভৈরবঘোর ও চন্ড কালী ।
জয়ত্রথ জামোল গ্রন্থে কালীর যে রূপ গুলির নাম পাওয়া যায় তা হলো ডম্বর কালী, রক্ষা কালিকা , ইন্দিবর কালিকা , ধনতো কালিকা , রমণী কালিকা , ঈশান কালিকা , জ্বিব কালী , বীর্য কালী , প্রজ্ঞা কালী ও সপ্তার্ণ কালী ।
এই সব রূপের মধ্যে দক্ষিণ কালীর বিগ্রহই সর্বাধিক পরিচিত ও পূজিতা । দক্ষিনা কালী চতুর্ভুজা । তার চার হাতে খর্গ, অসুরের ছিন্ন মুণ্ড , বর ও অভয় মুদ্রা রয়েছে । তার গলায় রয়েছে নরমুন্ডের মালা । দেবীর গায়ের রঙ কালো । মাথার চুল আলুথালু । এবং তিনি শিবের বুকে দান পা আগে দিয়ে দাড়িয়ে আছেন ।
বাংলায় মা কালীর উপাসক হিসেবে জনপ্রিয় নাম হলো , কৃষ্ণানন্দ অগম বাগিষ, বামা ক্ষ্যাপা , রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব , স্বামী বিবেকানন্দ, রামপ্রসাদ সেন , কমলা কান্ত প্রমুখ ।
কলকাতায় মা কালীর অনেক মন্দির আছে , তাই বাইরে মা কালী কে কোলকাত্তা ওয়ালিও বলা হয় । কোলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্দির হলো দক্ষিণেশ্বরের মন্দির । এছাড়াও আধ্যাপীঠ , ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি , ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি এগুলি হল বিখ্যাত কালী বাড়ি । এছাড়াও গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে অনেক জনপ্রিয় কালীবাড়ি আছে ।