বিশেষ প্রতিবেদন : দেব নামটি শুধু একজন অভিনেতার নাম নয় একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে এই নামটি একটি আবেগ । মনে আছে সেই ২০০৮ - ৯ সালের কথা ? তখন বাংলা সিনেমা মানেই দেবের ছবি , স্কুল ছুটি হলেই বাড়িতে গিয়ে সঙ্গীত বাংলা চালিয়ে দেবের গান শোনা , ছোটো থেকে বড়ো প্রায় সবাই কে একের পর এক হিট ছবি ও গান দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল এই অপরিচিত নতুন মুখ । যদিও দেব তখন আর অপরিচিত নেই । তিনি তখন সুপারস্টার ।
কিন্তু কেমন ছিল তার এই যাত্রাপথ ? জেনে নিন ।
দেব ভারতীয় বাংলা সিনেমার একজন জনপ্রিয় অভিনেতা , গায়ক , প্রযোজক ও ফ্লিম লেখক । এছাড়াও তিনি ভারতের পার্লামেন্টের একজন সদস্য । তিনি ঘাটাল কেন্দ্র থেকে তৃনমূল কংগ্রেসের হয়ে হয় লাভ করেন । বর্তমানে দেব বাংলা। সিনেমার সব থেকে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম একজন । দেবের আসল নাম দীপক অধিকারী তবে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সবাই তাকে দেব নামেই চেনে ।
সিনেমা জগতে তার পথ চলা শুরু হয় ২০০৬ সালে অগ্নিশপথ সিনেমার হাত ধরে । তিনি ১৯৮২ সালে কেশপুরের মহেশখালী নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন । প্রচুর ভক্তদের মনে তিনি তার জায়গা করে নেন ।
তার বাবার নাম গুরুদাস অধিকারী ও মা মৌসুমী অধিকারী । দেবের একটি বোন ও আছে যার নাম দিপালী অধিকারী । ২০১৫ সালের ৯ ই আগস্ট তার বনের বিবাহ সম্পন্ন হয় । দেবের ছোটো বেলা কাটে তার মামার বাড়ি চন্দ্রকোনায় । ছোটবেলার সবাই তাকে রাজ নামেই চেনে । প্রথম জীবনে আর বাকি ১০ জন সাধারণ অভিনেতাদের মতো দেব কেও অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয় । দেব ছোটবেলায় কিছু সময় তার মামার কাছে কাটিয়ে চলে যান মুম্বাই তে । ছোটো থেকেই দেব সিনেমার শুটিং দেখতে যেতেন আব্বাস মাস্তান ও প্রকাশ ঝাঁ এর সেটে। দেব একটি ইন্টারভিউ তে যখন বলেন তার বাবা অন্যান্য জিনিস নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন তখন তাকেই সব কিছু দেখতে হতো ।
যদিও দেব রান্না করতে পারতো না। তাই তিনি তার বাবার হয়ে মুদির দোকানে কাজ করতেন । তিনি আরও বলেন তার জীবনে এমনও সময় এসেছে যখন তাকে থালা ধোয়া ও ওয়েটারের কাজ করতে হয়েছে । মুম্বাইয়ে বান্দ্রার পরশুরাম হাই স্কুল থেকে তিনি স্কুল জীবনের পড়াশুনা শেষ করেন । ছোটো বেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র দেব পরবর্তী কালে পুনের ভারতীয় বিদ্যাপীঠ ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জনিয়ারিং এর পড়াশুনা শেষ করেন । এছাড়াও দেব "কিশোর নতিম" নামক অ্যাকটিং একাডেমী থেকে অভিনয়ের কোর্স করেন । অভিনেতা দেবের শিশু কাল থেকেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল । এর জন্যেই ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করার পর থেকেই অভিনয় জগতে আসার জন্য অভিনয় শিখতে থাকেন । তাই দেব ডিপ্লোমা অর্জন করার পরে আবার মুম্বাইয়ে ফিরে এসে আব্বাস মাস্তান এর "টারজান দা ওয়ান্ডার কার" এর অভিনয় শেখেন । অভিনয় শেখার পর ২০০৫ সালে বাংলার চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন অগ্নিশপথ সিনেমার হাত ধরে ।
এটি ছিল তার সিনেমা জগতের প্রথম ডেবিউ । এই সিনেমায় তার সহ অভিনেত্রী ছিলেন রচনা ব্যানার্জী। যদিও সিনেমা টি সাফল্য অর্জন করতে ব্যার্থ ছিল । বলাই বাহুল্য ২০০৭ সাল তার জন্য লাকি বছর ছিল । কারণ এই সালে তার দ্বিতীয় হিট ছবি শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস প্রযোজিত, রবি কিনাগী এর পরিচালিত "I love you" ছবিটি মুক্তি পায় । এই ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন পায়েল সরকার । সিনেমাটি বক্সঅফিসে হিট ছিল । এই সিনেমার মাধ্যেমে ধীরে ধীরে দেব কে দর্শক চিনতে শুরু করে । "I love you" সিনেমাটি ভালো সাফল্য পাওয়ার পরেও অভিনেতা এক বছর কোনো ছবির অফার গ্রহণ করেননি । শোনা যায় তিনি এই এক বছর আবার মুম্বাই গিয়েছিলেন নিজেকে সিনেমা জগতে আরো ভালো প্রতিষ্ঠা করার জন্য । মুম্বাইয়ে গিয়ে তিনি এজাজ গুলাব এর কাছ থেকে ফাইটিং ও নাচ শেখেন । এরপর তিনি আবার বাংলায় ফিরে আসেন এবং আবার সিনেমা জগতে কাজ শুরু করেন ।
তবে ২০০৮ সালে তার কামব্যাক ছিল অসাধারণ । এই সালে আবার রবি কিনাগি পরিচালিত "প্রেমের কাহিনী" ছবিতে তাকে দেখা যায় । তার বিপরীতে কাজ করেছিলেন কয়েল মল্লিক । "প্রেমের কাহিনী" সেই সময়ের সেরা হিট মুভি ছিল । যা আজও দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছে । এবং সেই সালেই আবার কয়েল মল্লিকের সাথে তাকে "মন মানেনা" ছবিতে কাস্ট করা হয় । এই সিনেমা ও বক্সঅফিসে দুর্দান্ত সাফল্য পায় । এবং দেবের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে । এই সিনেমার টাইটেল ট্র্যাক "মন মানেনা" নিয়ে দর্শকের মাতা মাতির শেষ ছিল না । পাশাপাশি দেব - কয়েল এর জুটি দর্শকের মনে জায়গা করে নেয় । ২০০৯ সালে জ্যাকপট সিনেমায় একটি অন্য চরিত্রে দেব কে দেখা যায় এবং সেই সালেই দেবের সুপার - ডুপার হিট সিনেমা রাজ চক্রর্তীর পরিচালিত সিনেমা "চ্যালেঞ্জ" মুক্তি পায় । এই সিনেমায় প্রথম বার তাকে দেখতে পাওয়া যায় প্রাক্তন প্রেমিকা শুভশ্রী গাঙ্গুলির সঙ্গে জুটি বাঁধতে । বলাই বাহুল্য তাদের জুটি দর্শকদের মনে পাকা জায়গা করে নেয়। সিনেমা হলের সামনে দেবের পোস্টার নিয়ে দর্শকের মাতা মতির কোনো শেষ ছিল না । এই ছবিটি সেই সময় প্রচুর সাফল্য অর্জন করেছিল । এবং এর পর থেকে দেবে জনপ্রিয়তা আরও অনেক বেড়ে যায় ।
এই ছবির জন্য আনন্দলোক অ্যাওয়ার্ড থেকে সেরা অভিনেতা ও সেরা অ্যাকশন হিরো এর পুরস্কার পান তিনি । এর পর থেকে একের পর এক হিট ছবি বাংলার দর্শকে উপহার দিয়ে গেছেন । এবং তার সুপার ডুপার হিট সিনেমা গুলির মধ্যে "পরান যায় জ্বলিয়া রে" , "বলোনা তুমি আমার " , "দুই পৃথিবী" , "পাগলু" , "পাগলু ২" , "রোমিও" , "খোকা ৪২০" , "চাঁদের পাহাড়" , "বুনো হাঁস" , "আরশিনগর" , "ককপিট" , "কবির" এছাড়াও আরও অনেক ছবি বক্সঅফিসে ভালো সাফল্য লাভ করে ।
বাংলা সিনেমা জগতে কাজ করার পাশাপাশি অভিনেতা দেব লোকসভা পার্লামেন্টের একজন সদস্য। ২০১৪ সালে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন । ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে ঘাটাল থেকে ভোটে দাড়ান এবং প্রচুর ভোটে জয়লাভ করেন । অভিনেতার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য মানুষের কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় । অভিনেতা হিসেবে রাজ্য সরকার তাকে "মহা নায়ক" পুরস্কারে সম্মানিত করেন । "জুলফিকার" ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য "এন এ বি সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলা ফ্লিমস আওয়ার্ড" পান । এছাড়াও স্টার আনন্দ "সেরা প্রতিভা" পুরস্কার, "সেরা বাঙালি অ্যাওয়ার্ড ২০১০" এর মতন সম্মান রয়েছে তার ঝুলিতে । ২০১৩ সালে কলকাতা টাইমসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরুষের তালিকার একদম প্রথমে ছিলেন দেব ।
অভিনেতা দেবের সাথে হিট অভিনেত্রী শুভশ্রী গাঙ্গুলির জুটি পর্দায় বেশ জনপ্রিয় ছিল । দর্শকদের একের পর এক বহু সুপারহিট সিনেমা উপহার দেন তারা । যার মধ্যে আছে "পরান যায় জ্বলিয়া রে" , "চ্যালেঞ্জ" , "খোকাবাবু" , "খোকা৪২০" ইত্যাদি । একসময় শোনা যায় দেব ও শুভশ্রীর ব্যাক্তিগত জীবনে প্রেমের সম্পর্ক আছে । ধির্ঘ ৫বছর পর তাদের ব্রেকআপ হয়েছে। দেব এক সাক্ষাৎকারে মেনে নিয়েছেন যে তাদের মধ্যে একসময় ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলেও এখন তারা শুধুই বন্ধু । শুভশ্রী গাঙ্গুলির এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন দেব তার জীবনের প্রথম ভালোবাসা । তবে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পর দীর্ঘ সময় এই জুটিকে পর্দায় আর দেখা যায়নি । বর্তমানে শুভশ্রী রাজ চক্রবর্তীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এবং অভিনেতা দেবের সাথে রুক্মিণী মৈত্রের সম্পর্কের কথা শোনা যায় টলি পারায় । "চাম্প" , "ককপিট" ও "কবির" পরপর তিনটি ছবিতে কাজ করার পর দেব ও রুক্মিণী এর সম্পেকের কথা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র । তবে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে একে অপরের বিষয়ে কথা বললেও সরাসরি সম্পর্ক স্বীকার করেননি এই দুই তারকা । তবে ইঙ্গিতে ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজেদের সম্পর্কের কথা ।
দেব টিভি সিনেমার পশাপাশি টিভি তেও কিছু কাজ করেছেন । সিনেমার বাইরে দেব টিভি তে জি বাংলার "ড্যান্স বাংলা ড্যান্স" নামক শো এর বিচারক পদে ছিলেন ।
অভিনেতা দেব যে শুধুই তার অভিনয়ের জন্য মানুষের মন জিতেছে তাই নয় । তার বড় মনের কারণেও দেবের ভক্ত প্রচুর । করনা কলিন পরিস্থিতিতে সকলে যখন আতঙ্কিত তখন মানুষের পাশে দাড়িয়ে মানবিকতার নজির গড়েছেন তিনি । কখনো থালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন আবার সংসদ দপ্তর কে পরিণত করেছেন আইসলেশন ক্যাম্পে ।
অভিনেতা দেবের পাশাপাশি গায়ক দেবেরও প্রথম দেখা মেলে "খোকা ৪২০" । ওই সিনেমায় দেব " "খোলা চালু চিজ" গানটি গেয়েছিলেন।
পরবর্তী কালেও দেবের অনেক ছবি বড়ো ছবিমুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে ।