চলুন জেনে নেই ঠিক কবে শুরু হয়েছিল এই দুর্গাপুজো
বিশেষ প্রতিবেদন : মহালয়ার মাধ্যমে আজ দেবীপক্ষের সূচনা হয়ে গেলো। পুজোর বাদ্যি বেজে উঠেছে আকাশে বাতাসে । কিন্তু বাংলার দুর্গাপুজোর ইতিহাস কী ?
উমার বাপের বাড়ি আসার সময় হয়েই গেছে । 'আশ্বিনের শারদ প্রাতে' আলোক মঞ্জির বেজে উঠেছে। আজ মহালয়ায় দেবীপক্ষের সূচনা হয়ে গেল । আগামীকাল থেকে শুরু হয়ে যাবে নবরাত্রি। এটা কেবল একটি উৎসব নয়, মিলনোৎসব বটে! গোটা বাংলা সেজে উঠেছে তার মেয়েকে বরণ করে নেওয়ার জন্য।
আজকাল থিম পুজোর যতোই বাড়বাড়ন্ত থাকুক না কেনো , দুর্গাপুজোর শুরু টা কিন্তু একদম এরকম ছিল না । আজকাল হয়তো অনেকেই মা দুর্গার আদি মনোমহিনী রূপের কথা ভুলে গেছেন । এবার কেউ কেউ হয়তো মায়ের সেই রূপ দেখেননি। অথচ এই দুর্গাপূজা ঘিরেই রয়েছে কতই না পুরান গাঁথা , প্রবাদ ।
৯০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দে পাল ও সেন রাজাদের আমলে বাংলায় দুর্গা প্রতিমার ভীত তৈরি হয়েছিল বলে অনুমান করা হয় । প্রত্নাত্ত্বিকরা মাটি খুঁড়ে এই সময়ের প্রচুর দুর্গা মূর্তি আবিষ্কার করেছেন ।
পুরাণ অনুযায়ী বসন্তকাল হচ্ছে দেবী দুর্গার পুজো করার আসল সময়। কিন্তু রাবণকে বধ করার জন্য রামচন্দ্র দেবীর অকালে আবাহন করেন তাঁর আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য। রাম যে দুর্গাকে পুজো করেছিলেন তাঁর দশটি হাত রয়েছে এবং তিনি মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। ফলে বরাবর আমরা যে উৎসবকে দুর্গোৎসব বলে জেনে আসছি সেটার আরেক নাম হল অকাল বোধন।
দেবী দুর্গা অনেক প্রাচীন দেবী, এমনটাই মনে করা হয় প্রত্নতত্ত্বের ভিত্তিতে। আদতে দুর্গাপুজোর সূচনা যে কবে হয়েছিল সেটা এখনও নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি। বাংলাদেশের ধনী বাড়িগুলোতে খুব সম্ভবত মোঘল আমল থেকেই দুর্গাপুজোর সূচনা ঘটেছিল।
কবে শুরু হয় এই পুজো ?
অনেকে মনে করেন প্রায় ১৫০০ শতকের শেরের দিকে এই পুজো বাংলায় শুরু হয় । লোককাহিনী অনুযায়ী দিনাজপুর বা মালদার জমিদার বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন । তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পুজো শুরু করেছিলেন পারিবারিক ভাবে। তবে সেই দেবী দুর্গার রূপ অন্যরকম ছিল। লোকমুখে শোনা যায় এই বাড়ির দেবীর বাহন হচ্ছে সাদা বাঘ এবং সবুজ সিংহ। অন্যদিকে দেবীর চোখ হচ্ছে গোলাকার। । আবার অনেকের মতে ১৬০০ সালে তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বা নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় প্রথম শারদীয়া দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন । আদতে কোনটি সঠিক তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে । তবে এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে ১৫০০ শতকের শেষ দিক থেকে ১৬০০ শতকের শুরুতে বাংলায় প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল।
অন্যদিকে কলকাতায় প্রথম
দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ। কলকাতায় একাধিক জমিদার বাড়িতে ব্রিটিশ আমলেও দুর্গাপুজো পালন করা হতো। নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে তখনকার দিনে দুর্গাপুজোয় যা খরচ করা হয়েছিল তাতে এই পুজো একটি গ্র্যান্ড ফিস্টে পরিণত হয়েছিল।
শরৎকালে যে দুর্গাপুজো হয় তাকে মোটামুটিভাবে ৪ ভাগে ভাগ করা যায় ।
১) সাবেকি / বনেদি দুর্গাপুজো : জমিদার বাড়িতে অথবা রাজবাড়ীতে যখন দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয় তখন সেই পূজোকে সাবেকি / বনেদি পুজো বলা হয় । এখনও কলকাতার বুকের জমিদার বাড়িগুলিতে সেই আদি কাল থেকে দুর্গাপূজো একইভাবে হয়ে আসছে ।
২) পারিবারিক দুর্গাপূজো: যখন একটি পরিবারের ব্যাক্তিগত উদ্যোগে দুর্গাপূজা আয়োজিত হয় তখন তাকে পারিবারিক দুর্গাপূজো বলা হয় ।
৩) বারোয়ারী দুর্গাপূজো : পারা বা ক্লাবে চাঁদা তুলে যখন দুর্গা পূজা আয়োজন করা হয় তখন তাকে বলে বারোয়ারী দুর্গাপূজো। এই বারোয়ারী পুজোর একটি ইতিহাস আছে। বারোজন বন্ধু মিলে প্রথমবার এই পুজো শুরু করেছিলেন বলে এমন নাম। ১৭৯০ সালে ১২ জন মিলে একসঙ্গে একটি পুজো শুরু করেন গুপ্তিপাড়ায়। এই পুজোটাকে বলা হতো বারো পল পুজো। সেই থেকেই আজ এর নাম বারোয়ারী পূজো।
৪) শক্তিপীঠ দুর্গাপূজো : কোনো পুরনো মন্দিরে শক্তির আরাধনায় দুর্গাপূজা করা হলে তাকে শক্তিপীঠ পূজো বলে ।
১৬১০ সালে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পূজোকে বাংলার প্রথম পারিবারিক পূজো সিহেবে মনে করা হয় ।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর রাজা নবকৃষ্ণ দেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ীতে , দুর্গা পূজার মাধ্যেমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন ।
মূলত এর পর থেকেই দুর্গা পূজা বাংলায় পরিচিতি লাভ করে । তারপর থেকেই বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দু জমিদারদের বাড়িতে দুর্গা পূজা আরম্ভ হয় । এবং কালক্রমে বাংলার পারায় পারায় , গ্রামে গ্রামে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হতে থাকে ।
১৯১০ সালে ডাক্তার হেমচন্দ্র সেন সহ আরো অন্যান্য প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে দিল্লিতে প্রথম দূর্গা পূজার আয়োজন করা হয়।
বর্তমানে ভারত ছাড়াও , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড , এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে দুর্গাপূজা আয়োজন করা হয় ।