বেগুনকোদর : ভারতের সবচেয়ে ভুতুড়ে রেল স্টেশন, যেখানে প্রায় ৪০ বছর ধরে কোনো ট্রেন থামেনি

 

 

বিশেষ প্রতিবেদন : পুরুলিয়ার বেগুনকোদর স্টেশন , যা ভারতের প্রথম ১০ টি ভুতুড়ে রেল স্টেশন এর মধ্যে নিজের জায়গা করে নিয়েছে । আমরা জানি বিজ্ঞান ভুত বিশ্বাস করে না । কিন্তু তবুও "ভুত" এই টপিক টাকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা যায়নি । কলকাতা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার  দূরে পুরুলিয়ার জেলার এই স্টেশন অবস্থিত । যার নাম বেগুনকোদর । এটি পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মাঝামাঝি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন । যার জন্য প্রায় ৪০ বছর ধরে  এই স্টেশনের উপর দিয়ে কমবেশি অনেক ট্রেনই গেছে । কিন্তু অদ্ভুতভাবে এখানে আজ অবধি কোনো ট্রেন থামেনি। থাকা ত দূরের কথা এই স্টেশন আসলে ট্রেন এর স্পীড আরো বেশি বেড়ে যেত । স্থানীয় লোকদের কাছে এটি ভুত স্টেশন নামেই পরিচিত । 


     কিন্তু প্রশ্ন হল কেনো ? 


এই গল্পটি স্বাধীনতার প্রায় ১৩ বছর পরের । যে সময় বেগুনকোদরে কোনো রেলওয়ে স্টেশন ছিল না। সবচেয়ে কাছের রেলওয়ে স্টেশন টিও ছিল অনেক দূরে । যার ফলে এখানকার লোকেদের ট্রেন ধরতে প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে যেতে হতো । এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে এখানকার লোকেরা বেগুনকোদর স্টেশন বানানোর জন্য আবেদন করতে থাকে । তাদের এই আবেদন সরকারের কাছে পৌঁছলে এখানে একটি স্টেশন বানানোর কাজ শুরু হয় ।


 এবং প্রায় ১৯৬২ সাল নাদাগ এই স্টেশন তৈরির কাজ সপূর্ণ হয় । যেহেতু গ্রামটি খুব একটা বড় ছিল না তাই স্টেশন টিও ছোট বানানো হয়েছিল । এখানে আলাদা করে কোনো প্ল্যাটফর্ম ছিল না,  শুধু একটা টিকিট কাউন্টার ও স্টেশন মাস্টার এর থাকার জন্য ছোট্টো একটি কোয়াটার বানানো হয় । যার ফলে বেগুনকোদর ও তার নিকটবর্তী গ্রামগুলোর সমস্যা অনেক কমে যায় । একটা সময় পর্যন্ত এটিও আর বাকি পাঁচটা সাধারণ স্টেশন এর মতোই ছিল । যেখানে ট্রেন থামত এবং সেই ট্রেনে লোক উঠতো আবার বেগুনকোদর স্টেশনে লোক নামতোও । এভাবেই কাটে প্রায় ৫ বছর । কিন্তু তারপর এমন কি হলো যার জন্য এই স্টেশনকে ভুতুড়ে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ? 




    শোনা যায় স্টেশন তৈরির ৫ বছর পর এখানে এক স্টেশন মাস্টারের পোস্টিং হয় । এবং তিনি ও তার স্ত্রী এই স্টেশনের সরকারি কোয়াটারে থাকতে শুরু করেন । এবং হটাৎ একদিন রাতে স্টেশন তিনি একটি মেয়েকে দেখতে পান , যে মেয়েটি ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গে  , ট্রেনটির সাথে সাথে ছুটছিল । প্রথমদিন তিনি ভাবেন হয়তো মেয়েটি ট্রেন ধরার জন্য দৌড়াচ্ছে । কিন্তু ঠিক এই একই ঘটনা রোজ ঘটতে থাকে । সবচেয়ে অবাক তিনি তখন হন যখন তিনি দেখেন রাত হলে ঠিক ট্রেন আসলেই সেই অচেনা মেয়েটির আবির্ভাব হয় এবং সেই মেয়েটি ট্রেনের থেকেও বেশি স্পীড এ ট্রাক বরাবর ট্রেনের সাথে দৌড়াতে থাকে ।



 এরপর রোজ রাতে তিনি সেই মেয়েটিকে দেখতে শুরু করেন । সেই স্টেশন মাস্টার দিনের বেলায় অনেক করে মেয়েটিকে খুব করে খোঁজার চেষ্টা করেন কিন্তু সেই মেয়েটির খোঁজ তিনি দিনে পেতেন না । যখনই রাতে ট্রেন আসতো তখনই মেয়েটিকে আবার দেখা যেতো। এই ঘটনাটি তিনি অনেকবার তার সহকর্মীদের বলার চেষ্টা করেন কিন্তু কেউ তার কথায় বিশ্বাস করেনি । শোনা যায় এর কয়েকদিন পরে মধ্যোরাতে স্টেশন মাস্টার ও তার স্ত্রী খুন হন ওখানে এবং তাদের বডি কোয়াটারের পাতকুয়ো তে তাদের বডি পাওয়া যায় । পুলিশ ও তাদের মৃত্যু বিষয়ে কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারেনি । লোকমুখে প্রচলিত এই ঘটনাটির পরে বেগুনকোদর স্টেশনে নেমে আসে কালো রাত । তৎকালীন সময় পর্যন্ত এই স্টেশনে ট্রেন থামত । কিন্তু এই ঘটনায় পরে , লোকমুখে শোনা যেতে লাগলো অনেক অলৌকিক কাহিনী । কেউ  বলতে থাকে এখানে নাকি রাতে আর্তনাদ শোনা যায়। আবার কেউ বলে এই স্টেশন দিয়ে ট্রেন গেলে নাকি কোনো অশরীরী ছায়ামূর্তি ট্রেন এর আগে আগে চলে যায় । সেই থেকেই এই এর নাম ভুতুড়ে স্টেশন । 



বহু রেল কর্মীও একাধিক বার নানান ভুতুড়ে ঘটনা নিজে চোখে দেখারপর  ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যায় । ধীরে ধীরে বেগুনকোদরের এইসমস্ত ভুতুড়ে কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে গোটা জেলা থেকে শুরু করে গোটা দেশজুড়ে । অশরীরী আত্মার ভয়ে সন্ধ্যা নামলেই সুনসান হয়ে যায় বেগুনকোদর ।  স্টেশনের এই খবর রেলের উপর তলায় পৌঁছলে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় রেল চলাচল । শুধু মাত্র আপ ডাউন লাইনে কোনো দূরপাল্লার ট্রেন থাকলে শুধুমাত্র সেটিই চলাচল করে এই স্টেশন থেকে । এবং আবার অন্ধকার গ্রাস করে এই বেগুনকোদর স্টেশন কে । ধীরে ধীরে খন্ডহারে পরিণত হয় গোটা এলাকা । শুধু মূর্তিমান বিভীষিকার মতো দাড়িয়ে থাকে স্টেশন বিল্ডিংটা। রাতে নাকি সেখানে খেলা করে নানা আলো। 



    সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত বেগুনকোদর নিয়ে নানা গল্প । ইন্টারনেট খুললেই ভুতুড়ে স্থানের মধ্যে বেগুনকোদরকে একেবারে পয়লা নম্বরে পাওয়া যায় । ভুতের ভয়ে ১৯৬৭ সাল থেকে টানা ৪ দশক এখানে কোনো ট্রেন থামেনি । সরকারি নথিতে এই স্টেশন এ কোনো রেল কর্মচারীর কাজ না করতে চাওয়ার পেছনে এর ভুতুড়ে কারণের কথা লেখা হয় । রাত হলেই কোনো মেয়ের ট্রাক এর উপর ট্রেন এর আগে আগে দৌড়ানো , নাচা ইত্যাদি কোনটাই শুধু আর গুজব থাকেনি যেদিন থেকে ভারতীয় রেলওয়ের রেকর্ড বুকে এই স্টেশন টিকে হনটেড বলে উল্লেখ করা হয়েছে । এখানকার এম এল এ , মন্ত্রী সবাই এই স্টেশনে কোনো অশরীরী ছায়ামূর্তির কথা স্বীকার করে নেয় , এবং এই স্টেশন টিকে পরিতত্ত করতে সায় দেন । কারণ এই ভুতুড়ে মেয়েটিকে দেখার পর অনেকেই মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন । এরপর এই স্টেশন এলেই লোকো পাইলট ট্রেনের স্পীড আরো বাড়িয়ে দেন যাতে ট্রেনটি তারাতারি পার হয়ে যায়।  এবং ট্রেনের ভেতরে থাকা যাত্রীরাও ট্রেনের জানলা দরজা সব বন্ধ করে দেয় । 




     এভাবেই বেগুনকোদর একটি হন্টেড ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন এ পরিণত হয় । প্রচুর মানুষ এখানে দিনের বেলায় ভির জমাতে থাকে । এবং অবশেষে ইন্ডিয়ান প্যারানরমাল  ইনস্টিটিউট থেকে প্রায় ১১ জনের সদস্যের টিম তাদের আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে এই স্টেশন পর্যবেক্ষণ করতে আসেন । তারা সকালে গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলেন এবং রাতে স্টেশন টি ঘুরে দেখেন তাদের "নেগেটিভ এনার্জি ডিটেক্ট" মেশিন দিয়ে । কিন্তু সেখানে তারা কিছুই খুঁজে পাননি । 



    আসতে আসতে মানুষের মনে ভয় কমতে থাকে এবং তারা আবার স্টেশন টিকে চালু করার আবেদন জানায় । এরপর ২০০৯ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৌলতে স্টেশনটিকে আবার মেরামত করা হয় । কিন্তু তারপরও এখানে মানুষের মধ্যে থাকা ভীতি পুরোপুরি দুর করা যায়নি । এখন এখানে বিকেল ৫ টায় থামে "রাচি চন্দ্রপুরা ধনবাদ প্যাসেঞ্জার" এরপরে আর কোনো ট্রেনের স্টপেজ দেওয়া হয়নি এখানে । নেই কোনো রেলের স্থায়ী কর্মী  । আজও এখানে সন্ধের পর কোনো লোকজন দেখা যায়না ।

নবীনতর পূর্বতন