বিশেষ প্রতিবেদন : আসাম উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য। আসামের অধিবাসী বা আসামের ভাষাকে অসমীয়া নামে আখ্যায়িত করা হয়। তবে আসামের এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসী বাঙালী। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যটি হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত এবং এর অভ্যন্তরে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ, বরাক উপত্যকা এবং উত্তর কাছাড় পর্বতমালা। উত্তর-পূর্ব ভারতের আরও ছয়টি রাজ্য, যথা অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয় দ্বারা আসাম পরিবেষ্টিত এবং আসামসহ প্রতিটি রাজ্যই উত্তরবঙ্গের একটি সঙ্কীর্ণ অংশ দ্বারা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত।এছাড়াও আসামের আন্তর্জাতিক সীমানায় রয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটান এবং বাংলাদেশ।
চলুন জেনে নেই উত্তর পূর্ব ভারতের সাতটি বোনের (অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, মনিপুর, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা এবং অসম) মধ্যে এক বোন অসাম এর সম্পর্কে।
আসামের আধিকারিক ভাষা হলো আসামি । এই রাজ্যের সম্পূর্ণ ক্ষেত্রফল ৭৮,৪৪০ বর্গ কিলোমিটার। যার দরুন অসাম ভারতের ১৭ তম বৃহত্তম রাজ্য। এই রাজ্য সমুদ্র থেকে ১৯৬০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত ।
২০১১ সালের সার্ভে অনুযায়ী এই রাজ্যের টোটাল জনসংখ্যা হলো ৩ কোটি ১৩ লক্ষ্য , যার জন্যে অসাম ভারতবর্ষের মধ্যে ১৫ তম স্থানে রয়েছে জনসংখ্যার দিক থেকে । আসামে শিক্ষিতের হার ৭৩ % । আর এই রাজ্যে মোট ৩৩টি জেলা রয়েছে ।
অসাম রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন গোপীনাথ বর্নলোই আর রাজ্যপাল ছিলেন মোহম্মদ সালেয়া আকবর হায়দরেই । এখানে ৫০% লোক অসমীয়া ভাষাতে কথা বলেন । ২৭% বাংলা ভাষায় , হিন্দি ৬% , বোরো ৫% ,নেপাল ৩% এবং বাদবাকি শতাংশ অন্য ভাষায় কথা বলে ।
ধর্মের দিক থেকে দেখলে ২০১১ সালের গণনা অনুসারে এই খান ৬০% হিন্দু , ৩৫% মুসলিম , ৪% খ্রিস্টান আরও অন্যান্য ধর্মের লোক থাকে ।
অসাম রাজ্যের একটু ইতিহাস : আসামের ইতিহাস বহু পুরনো ও প্রাচীন । আসাম কে প্রাচীন কালে প্রগজতিস্পুর বলা হতো । এই রাজ্যের বর্ণনা ভারতের হিন্দু গ্রন্থ মহাভারতেও করা হয়েছে । মৌর্যযুগে রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আসামের প্রাচীন ভাগ জয় করেন এবং এটি নিজের শাসনাধীনে নিয়ে আসেন । মধ্যযুগে মুসলিম শাসকরা অসাম ভূপালকে নিজেদের অধীনে করে নিয়েছিলেন এবং তারপর ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি আসামের কিছু প্রদেশ নিজের অধীনে আনেন । কিন্তু পরবর্তী কালে অহোম রাজা পুনরায় অসাম রাজ্যকে নিজের করে নেন । ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর এই রাজ্যের রাজধানী হয় শিলং তবে সাংস্কৃতিক , জাতি ও মতভেদের কারণে ১৯৬৮ সালে নাগাল্যান্ড ১৯৭২ সালে মেঘালয় এবং মিজোরাম অসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । ফলে আসামের নতুন রাজধানী হয় দিজপুর।
আসামের ভৌগলিক স্থিতি : আসাম রাজ্যের পার্শ্ববর্তী দেশগুলি হলো পূর্ব দিকে মায়ানমার , উত্তর দিকে ভুটান আর দক্ষিণ দিকে বাংলাদেশ । এছাড়াও বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদ, যাকে আসামের লাইফ লাইন ও বলা হয় । ব্রহ্মপুত্র নদকে এই রাজ্যের মুখ্য আধারও বলা হয় । এই রাজ্যের ৮০% কৃষি এই নদের কারণে গড়ে উঠেছে । এই বিশাল নদী ১০০ কিলোমিটার চওড়া ও ১০০০ কিলোিটার লম্বা । আসামের ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যে অবস্থিত মাজুলি দ্বীপ বা মাজুলী আইল্যান্ড পৃথিবীর সব থেকে বড় নদীর দ্বারা তৈরী দ্বীপ ।
আসাম রাজ্য কাজিরাঙা ও মানস নেশনাল পার্ক , এক সিং ওয়ালা গন্ডার এবং নানান প্রজাতির পাখি ও হাতির কারণে পুরো দুনিয়ার মধ্যে প্রসিদ্ধ । আসাম দুনিয়ার মধ্যে সব থেকে বেশি জৈববৈচিত্র্যময় প্রদেশ । যার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঘাস থাকে শুরু করে বাসের জঙ্গল আর ট্রপিক্যাল নেশানাল রেইন ফরেস্ট ও রয়েছে । এই রাজ্যের সুন্দরতা, শাল গাছের জঙ্গল , আর এই জঙ্গল থেকে তৈরি সামগ্রীর কারণে আসাম রাজ্য পরিচিতি লাভ করেছে । এখানে প্রায় ৮২০ প্রকার পাখির প্রজাতি রয়েছে , আর প্রায় ২০০ প্রকারের স্থলধারী প্রাণী পাওয়া যায় ।
গুয়াহাটি আসামের সবথেকে বড় জনপ্রিয় শহর । এই শহরটি দুনিয়ার মধ্যে টপ হান্ড্রেড ফাস্টটেস্ট গ্রোইং সিটি ( Top hundred fastest growing city) এর মধ্যে একটি ।
আসামের আর্থিক স্থিতিও ভালো । প্রতি ব্যাক্তির আমদানির দিক থেকে অসাম রাজ্যের ভারতের মধ্যে ভালো জায়গায় আছে । বিহার , উত্তরপ্রদেশ , মনিপুর আসাম রাজ্যের থেকে পিছিয়ে রয়েছে । এই রাজ্যে সব থেকে বেশি কাচাতেল এর ভান্ডার রয়েছে । ভারতের প্রায় ৫০% খনিজ তেলের ভান্ডার সুরক্ষিত আছে এখানে । ভারতের ৩৫% পেট্রোলিয়াম এর চাহিদা মেটাতে অসাম সক্ষম । তবে চা উৎপাদনের ব্যাপারে অসাম ভারতের মধ্যে প্রথম স্থানে আছে । আসাম ভারতের ৫৫% চা , ও পৃথিবীর ১৬% চা এর জোগান দেয় । এখানে সব থেকে বেশি রেশম কাপড় উৎপাদন করা হয় । আসাম তার সংস্কৃতি ও সবুজ মনোরম পরিবেশের জন্য গোটা দুনিয়ার কাছে বিখ্যাত । যে দিকে তাকাবেন শুধু পাহাড় পর্বত নদী ও বনের দেখা মেলে এই রাজ্যে ।
আসাম রাজ্যটি ১ লা এপ্রিল ১৯১২ সালে স্থাপিত হয়। এই রাজ্যে ১২৬ টি বিধানসভা ও ১৪টি লোকসভা সিট রয়েছে । এইখানকার রাজকীয় পশু এক সিং আলা গন্ডার । রাজকীয় ফুল ফক্স ডেলট অর্কিড ফুল , এবং কোলান হলো এখানকার রাজকীয় বৃক্ষ । আসামের রাজকীয় পাখি হলো হোয়াইট উইংড হুডাক পাখি । এইখানেই রয়েছে এশিয়ার প্রথম তেল শোধনারগার "ডিগবয়ে শোধনাগার" যার স্থাপনা ১৯০১ সালে করা হয়েছিল । আসামের মূল ফেস্টিভ্যাল গুলি হলো দুর্গা পূজা, বাথুয়া পূজা , করাগ, বেসাগু আর বিহু পুজো ।
যারা জীব ও প্রকৃতিকে ভালোবাসেন তাদের জন্য স্বর্গস্থল হলো এই অসাম রাজ্য । তাই একবার অবশ্যই এই অপূর্ব সুন্দর রাজ্য ঘুরে আসবেন ।